রোজার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাশবিকতাকে দমন এবং নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের সুন্দর ব্যবস্থা বিদ্যমান। রমজানে তাই এক মাস ব্যাপী আত্মশুদ্ধির যে পরম চর্চার আয়োজন চলে তা বাহ্যিকভাবে পরিলক্ষিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু পেটের দায়ে এবং রুজির যোগানে আধুনিক যুগে আমাদের ঘর থেকে বের হতেই হবে সেহেতু ঈশ্বরের কাছে অন্তরের কুটিলতা, অপবিত্রতা আর অমানবিকতা বর্জনের পরীক্ষা দেবার এটাই উত্তম পন্থা। অসংখ্য লোভ-লালসার ভিড়ে আমাদের মুখ,হাত,নফস,কর্মকাণ্ড এবং মস্তিষ্ককের সহনশীলতা, উদারতা আর নিয়ন্ত্রণ করানোর এটাই প্রায় একমাত্র আধ্যাত্মিক ইবাদত। সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কিছু দায়বদ্ধতা আমাদের রমজান মাসে ঈশ্বর সাধনায় আনতে পারে ঐশ্বরিকতা। জেনে নেই এ মাসে আমাদের করণীয় কিছু কর্তব্য।
- আপনার রোজদার দুর্বল সহকর্মীর প্রতি বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যবহার করুন। পারতপক্ষে তাঁকে এমন কোন শ্রমসাধ্য কাজে আটকাবেন না যা তাঁর শারীরিক সামর্থ্যের প্রতিকূলে।
- ‘কেন রোজা রাখেন নি’ এরকম মূর্খতাপূর্ণ প্রশ্ন রোজা অপালনকারী সহকর্মীকে বার বার করা হতে বিরত থাকুন। একজন মুসলিম বিভিন্ন ব্যক্তিগত সমস্যার কারনে রোজা না রাখতেই পারেন যা আপনার সাথে জনসম্মুখে আলোচনায় তিনি স্বচ্ছন্দ নন। আপানি বার বার একই প্রশ্ন করে তাঁর কর্মক্ষেত্রকে অস্বস্তিদায়ক করে তুলছেন।
- রোজা না রেখে থাকলে অবশ্যই আপনার রোজদার সহকর্মীকে সাহায্য করুন। তাঁর সামনে পোশাক-আশাক আর আচার-ব্যবহার সঙ্গতিপূর্ণ করে তাঁকে বোঝান তাঁর ইবাদতের প্রতি আপনার যথেষ্ট সম্মান রয়েছে।
- বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জিং এবং সকল প্রকার মিটিং ও আলোচনা ভিত্তিক কাজগুলো সকালেই সেরে ফেলুন। কেননা না খেয়ে থাকার প্রভাব সবচেয়ে বেশি দুপুরের পরেই পরিলক্ষিত হয়। রুটিন মাফিক কাজগুলোতে তাই দুপুরের পর পরেই হাত দিন।
- আপনি যদি বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি করে থাকেন এবং আপনার সহকর্মীরা যদি মুসলিম না হন তাহলে আপনার বিধিনিষেধ সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা পূর্ণ অবগত না থাকতেই পারেন। তাঁদের কোনরূপ কথা বা ব্যবহারে সহসাই নেতিবাচক না হয়ে হাসিমুখে আপনার অপারগতার কথা জানান। আপনার ম্যানেজারকে অবশ্যই এই একমাসে আপনার করণীয়, অফিস গমনের সময় সীমা এবং শারীরিক মানসিক বিধিমালা সম্পর্কে আগেই অবহিত করুন। এই মাসে আগে আগে এসে কাজ শুরু করে অফিস আওয়ার শেষ হবার আগেই ছুটি অনুরোধ করার সাথে সাথেই ম্যানেজমেন্টকে পরবর্তী মাসে বাড়তি কাজ শিডিউল করে দিতে বলুন। এতে আপনার ইবাদত আর কাজের প্রতি একাগ্রতা প্রকাশ পাবে।দেখবেন আপনার অমুসলিম সহকর্মীরা রমজান চলাকালীন আপনার প্রতি কতটুকু যত্নবান হইয়ে ওঠেন।
- অফিসিয়াল লাঞ্চ এবং বিভিন্ন ম্যানেজম্যান্ট মিটিংগুলো খাদ্যমুক্ত রাখতে পারেন আপনার রোজাদার সহকর্মীর সম্মানে। একেবারেই সম্ভব না হলে তাঁর সাথে কথা বলে বিষয়টির ব্যাপারে মৌখিক অনুমতি চাইতে পারেন। তাঁরা আপনার অবস্থান বিবেচনা করবেন এবং এতে করে আপনার সুসম্পর্ক আরও বাড়বে।
- ‘স্বাস্থ্য কমানোর জন্য রোজা রাখছি’ এইরূপ অনর্থক বাক্যালাপ অন্যকে শোনানো বর্জন করুন। রমজান কোন ডায়েট করার উপায় নয় বরঞ্চ ইহা কঠোর নিয়মকানুনের মাধ্যমে নিজের পরিশুদ্ধি লাভের পথ। অনেকের জন্য রমজান গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।এই কথা বলার মাধ্যমে আপনি অন্যের ইবাদতকে অজান্তেই পরিহাস করে বসতে পারেন।
- অনেকেই শারীরিক কারনে কাজ এবং রোজা এক সাথে পালন করতে পারে না। তাঁরা বার্ষিক ছুটিগুলোর আবেদন একসাথে এই মাসের জন্য করতে পারেন।
- ইফতারের আমন্ত্রণ গ্রহন করুন। এমনকি আপনি বেরোজদার অথবা অমুসলিমই হন না কেন।ইফতারের খাবার গরিবদের মাঝে বিলানো এবং ইফতারের আমন্ত্রণে সকল সম্প্রদায়ের এক সাথে আহার করার সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরোন। ভাতৃত্ববোধের অনন্য উদাহরন।
রাসূল(সাঃ)বলেন, “যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করে না তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৪) সুতরাং রমজানের শুরুতেই আমরা যেন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি আমাদের জৈবিক সকল অমানবিক প্রবৃত্তিকে। সামাজিক পরিবেশে আর কর্মক্ষেত্রে মেনে চলি কিছু সাধারণ মার্জিত আচার ব্যবহার।যত্নবান হই একে-অপরের প্রতি, সহানুভূত হই সমাজের সর্বক্ষেত্রে শ্রমজীবীদের আত্মত্যাগে।যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যে পালন করি সিয়াম সাধনার এই মাসটি। উষর আত্মিক পরিত্রাণে নিমগ্ন সকল সহকর্মীকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানাই রমজানের প্রথম দিনেই ‘রমজানুল মুবারাক’।